সমাজে একজন নারী যখন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তখনই এই সমাজ তাঁকে 'ডাইনি' অপবাদ দেয়। কাশ্মীরের ডাইনি রানি দিদ্দার জীবনের বহু অজানা রহস্যময় অধ্যায় নিয়ে রচিত হয়েছে এই উপন্যাস। এটিকে দিদ্দার জীবনের ঐতিহাসিক দলিল বলা যেতে পারে।

কালের ঘূর্ণির মধ্যে রক্তাক্ত এক চিত্রপট — যেখানে খাগের কলম ডুবিয়ে মহাকাল রচনা করেছেন কাশ্মীরের ইতিহাসের এক রহস্যময় ও বিতর্কিত নারীর জীবনের ইতিবৃত্ত। তিনি দিদ্দা — সেই রানি, যাকে জন্মলগ্নেই পিতার নির্দেশে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। কলহন তাঁর ‘রাজতরঙ্গিনী’তে দিদ্দাকে ‘ডাইনি রানি’ আখ্যা দিয়েছেন। তবু সেই ভয়ঙ্কর অভিধার আড়ালেও দিদ্দার জীবনকথা বয়ে চলে এক বিস্ময়কর অধ্যায়। খ্রিস্টীয় দশম শতকের কাশ্মীরের এই রানি প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত কাহিনির মোড়কে আজও বেঁচে আছেন মানুষের মুখে মুখে।

দিদ্দার শাসনকাল — ৯৮০ থেকে ১০০৩ খ্রিস্টাব্দ — নানা রাজনৈতিক উত্থানপতন, কূটকচালি, এবং ক্ষমতার পুনর্দখলের গল্পে ভরপুর। কখনও তিনি ছেলের হয়ে, কখনও নাতির হয়ে, কখনও সরাসরি নিজেই রাজ্য শাসন করেছেন। কিংবদন্তি বলে, তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরও দিদ্দার গড়া একাঙ্গি সেনা এমন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল যে, গজনীর সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা কাশ্মীরের সীমান্তেই থমকে যায়।

দিদ্দা ছিলেন একাধারে নির্মাতা ও ধ্বংসের দেবী। বহু মঠ-মন্দির স্থাপন করে গিয়েছিলেন তিনি। তবু কলহন তাঁকেই বারবার কলঙ্কের আভরণে আচ্ছাদিত করেছেন— তাঁকে বলেছেন ডাইনি, দুশ্চরিত্রা, পিশাচসিদ্ধা। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, দিদ্দার মৃত্যুর দেড়শো বছর পর লেখা ‘রাজতরঙ্গিনী’ মূলত সেই সময়ের লোককাহিনির প্রভাবে দিদ্দাকে এমন বিতর্কিত রূপে চিত্রিত করেছে। পিতৃতান্ত্রিক ইতিহাসে একজন নারী যদি নিজস্ব শক্তি ও প্রজ্ঞায় নিজের সময়ের চেয়ে অনেক উঁচুতে ওঠেন, তখনই শুরু হয় তাঁর অবদানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত— ইতিহাসের পাতা থেকে তাঁকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র।

দিদ্দার জীবনকথা তাই শুধুমাত্র এক রানি বা এক জননীর কাহিনি নয়— এ যেন এক নারীর লড়াই, নিজের শাসনকৌশল, বুদ্ধিমত্তা ও নির্মোহ নীতির সঙ্গে সমকালীন সমাজের সংঘাতের প্রতিফলন। আজও কাশ্মীরের নারীদের ‘দেদ’ বা ‘দিদ্দা’ নামে সম্ভাষণ করা হয়— এই ইতিহাসের আড়ালে সেই দিদ্দারই অমর সত্তা বেঁচে থাকে।