গল্প লেখা শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালের দিকে। সবে কৈশোরের গন্ডি পেরিয়ে তরুণ এক মন, যার মধ্যে জমে উঠছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতা, অনুভব ও প্রশ্নের সঞ্চার। কিন্তু সেই লেখালিখি ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব পরিসরে—ডায়েরির পাতায়, খামের ভেতর, বা কোনো বন্ধুর খুপরিতে। সেসব গল্প প্রকাশের মুখ দেখেনি, কারণ লেখার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে লেখার ভেতরের দ্বন্দ্ব। তারপর একদিন, অনেক ঘুরে-ফিরে, ২০১৭-১৮ নাগাদ প্রথম প্রকাশ পেল একটি গল্প। সে এক ছোট ম্যাগাজিনে, সীমিত পরিসরে, কিন্তু পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া এক প্রয়াস।

২০২৫-এ এসে যখন প্রথম একক গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসা, তখন হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত শূন্যতার মুখোমুখি হতে হল। এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও, সত্যিকার অর্থে হাতে গোনা কিছু গল্পই টিকেছে। বহু লেখা হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে, কিছু লেখা নিজেই অস্বীকার করেছি, কিছু যেন লিখেই ভুলে গেছি। বহু আত্মসমীক্ষা, বহু আত্মপ্রশ্নের পর এগারোটি গল্প বেছে নেওয়া গেল—যাদের মধ্যে এখনো কিছু স্পন্দন বাকি আছে, কিছু আর্তি রয়ে গেছে।

বইয়ের নাম নেওয়া হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক কবিতা থেকে—“দেরি হয়ে যায়”। নামটি শুধুই এক সাহিত্যিক সম্মান নয়, এটি এই সংকলনের আত্মা। কারণ এই বই আসলে দেরি হয়ে যাওয়া সমস্ত স্বীকারোক্তির কথা বলে, সেইসব গল্পের কথা যাদের বলার জন্য সময়টা যেন কখনও ঠিক ছিল না।

এই সংকলনের প্রতিটি গল্প কোনও না কোনওভাবে আত্মজৈবনিক। কল্পনার চেয়েও বেশি বাস্তব, আর বাস্তবের থেকেও বেশি পরাবাস্তব মনে হতে পারে কখনও। যারা লেখকের ব্যক্তিগত জীবন, ভাবনার জগৎ কিংবা অতীতের ছায়াগুলিকে জানেন—তারা হয়তো এই গল্পে কিছু পরিচিত মুখ, পরিচিত দৃশ্য, বা বিস্মৃত গন্ধ খুঁজে পেতে পারেন। কিন্তু লেখক নিজে—যিনি আছেন এই গল্পগুলোর অন্তরালে—তাঁকে চিনে ফেলা কঠিন। কারণ এই বইয়ের লেখক কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি নন, বরং তিনি এক অনুচ্চারিত অভিজ্ঞতা, এক নিরব অবচেতন।

আমার বিশ্বাস, সত্যিকারের গল্প কখনও গল্পহীন হয় না। আবার সেইসব গল্প, যাদের রচনার মধ্যে নিজের জীবন, নিজের অনুভব, নিজের ব্যর্থতা বা ক্ষয় নেই—সেগুলিও কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। এই বই সেই অসম্পূর্ণতার এক প্রামাণ্য দলিল, যাকে আমি সাহস করে গল্প বলার প্রথম প্রয়াস বলতে চাই।

এ বইয়ের পাঠকদের একটাই অনুরোধ—গল্প পড়ুন, নিজের মতো করে। যদি কোথাও গিয়ে মনে হয়, “এটা তো আমারও গল্প হতে পারত”—তবে বুঝব, সত্যিই আর খুব একটা দেরি হয়নি।