রমানাথ বিরচিত মহাভারত – ভাষার বহুস্বরে বুনে তোলা এক আঞ্চলিক মহাকাব্যচর্চা

‘মহত্ত্বাদ্ ভারবত্ত্বাচ্ চ মহাভারতঃ উচ্যতে’—এই শ্লোকটির মতোই রমানাথ বিরচিত মহাভারত শুধুমাত্র এক মহাকাব্যের অনুবাদ নয়, বরং বাংলা-ওড়িয়া-সংস্কৃত ভাষার আন্তঃসম্পর্কের এক জীবন্ত দলিল। মধ্যযুগীয় পূর্ব ভারতের বহুভাষিক ও বহুসাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠা এই পাঠ সমগ্র মহাভারতচর্চার এক স্বতন্ত্র প্রবাহ নির্মাণ করেছে।

বইটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বনপর্বের সেই আলোচিত সাবিত্রী উপাখ্যান, যা ঋষি মার্কণ্ডেয়র মুখে উঠে আসে দ্রৌপদীর তুলনায় আরও উচ্চতর নারীচরিত্রের দৃষ্টান্ত হিসেবে। কিন্তু এই গ্রন্থে আলোচনার পরিধি এই একটি উপাখ্যানের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়—এখানে প্রকাশ পেয়েছে যুধিষ্ঠিরের বনবাসকালীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়সদৃশ’ শিক্ষা-অভিজ্ঞতা, গুরুবরণ ও জ্ঞানপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে এক নায়কের বোধবিকাশ।

বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এই বইয়ের ভাষাতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট। পাঠক আবিষ্কার করবেন কীভাবে উৎকল ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ সম্প্রদায়ের কলম ও কণ্ঠে গড়ে উঠেছে এক মানভূমি-ওড়িয়া-বাংলা সংমিশ্রিত মহাভারত ভাষ্য। এই পাঠ শুধু অনুবাদ নয়—এ এক আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও মৌখিক পরম্পরার মিশ্রণে গঠিত এক ঐতিহাসিক রচনাস্বাক্ষর।

রচনাটি ভাষার সীমানা ও সাহিত্যের কেন্দ্রচ্যুতি ঘটিয়ে তুলে আনে প্রান্তিক সাহিত্যের বিস্মৃত অথচ অপরিহার্য একটি ধারা। গায়েন দাস দামোদর ‘মধুকণ্ঠ’, যিনি সম্ভবত একজন উৎকল ব্রাহ্মণ, তাঁর কণ্ঠনির্ভর উপস্থাপনাতেই এই গ্রন্থের শ্রুতি ও লিখিত সংস্করণ পরস্পরকে স্পর্শ করে।

রমানাথ বিরচিত মহাভারত তাই কেবল একটি উপাখ্যানভিত্তিক মহাকাব্যসংকলন নয়—এ এক সামাজিক-ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসের দলিল, যেখানে জড়িয়ে আছে পূর্বভারতের বহুস্বরা লোকচেতনা ও প্রান্তিক সাহিত্যের দীর্ঘ, নিরবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা।