"বালুচ দস্তাবেজ" গ্রন্থটিকে একটি প্রচলিত উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন। বরং, একে বালুচিস্তানের আত্মিক ধারাভাষ্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বালুচিস্তানের ইতিহাসকে কাল্পনিক সংমিশ্রণের মাধ্যমে এক অভিনব রূপে গড়ে তোলা হয়েছে এই লেখায়।

এই গ্রন্থে যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা লেখিকার পূর্ববর্তী সৃষ্টিসমূহ থেকে স্বতন্ত্র বলে বিবেচিত হতে পারে। একে সাহিত্যকর্ম হিসেবে না দেখে, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দস্তাবেজের অংশ হিসেবে বিচার করা অধিক যুক্তিসঙ্গত হবে। 

পাঠ শুরু করার আগে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে—বালুচিস্তানের সমস্যাকে বাইরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বালুচিস্তানকে বোঝার জন্য তার আত্মাকে অনুভব করা জরুরি, যা কেবল প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই সম্ভব। ১৯৪৮ সালে কালাত অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে সময়কে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করে তুলে ধরা হয়েছে বালুচিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের চিত্র। পাকিস্তানের শাসকেরা কিভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে এই অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সেই বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে নথিভুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে।

"ফালহা-ই-ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশন" নামক সংগঠনের মাধ্যমে কীভাবে চরমপন্থা ও ধর্মীয় কট্টরতা ছড়ানো হচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চালানো হচ্ছে মগজ ধোলাই, এবং সভ্যতা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এই লেখায়। ভারতের কচ্ছের রান থেকে শুরু করে জম্মু কাশ্মির হয়ে পূর্ব ভারত তথা দক্ষিন ভারতের মাদ্রাসাগুলোতে এদের ছাপা বই পড়িয়ে মগজ ধোলাই চলছে। একটি ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে শেষ করে দেওয়ার ভয়ানক চক্রান্ত। মুম্বাই হামলার প্রধান চক্রি তথা এই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতাকে লাহোরে জোহরমহল্লায় House No. 116E-Mohalla Johar তার ঘরের মধ্যেই শেষ করার প্রস্তুতি চালিয়েছিলেন একদল দেশপ্রেমি। কিন্তু তা সফল হয়নি। তারপর! বালুচিস্তান সমস্যার সাথে এই মানবরূপি "রাক্ষসের" কোনো সম্পর্ক আছে কি? 

বর্তমান সময় পাকিস্তান বিপুল পরিমাণ অর্থের ঋণ পরিশোধ করার জন্য বালুচিস্তানকে এক প্রকার চিনের হাতে তুলে দিয়েছে। চিন কাশগর থেকে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে এক দীর্ঘ পথ তৈরি করেছে, যা বালুচিস্তানের গুয়াদার বন্দর পর্যন্ত গিয়েছে। এই দীর্ঘ পথকে চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর নাম দেওয়া হয়েছে। চিনের সাথে চুক্তির মাধ্যমে বালুচিস্তানকে কীভাবে অর্থনৈতিক করিডোরে পরিণত করা হয়েছে এবং এই করিডোরের আড়ালে কীভাবে বালুচদের ওপর শোষণ চালানো হচ্ছে, তার বর্ণনা স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বালুচিস্তানে ঘটতে থাকা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিবরণ যেমন গণকবর, হেলিকপ্টার থেকে ফেলে হত্যা, শিশুদের পুড়িয়ে দেওয়া, রেপ সেন্টারে নারীদের ওপর নির্যাতন—এই ভয়াবহ চিত্রগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে নৃশংস বাস্তবতাকে স্পর্শ করিয়ে।

বিএলএ ও মাজিদ ব্রিগেড-সহ বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী সংগঠনের উদ্দেশ্য, কর্মকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দিকগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে পাকিস্তান কতটা পরিকল্পিতভাবে ভারতের অভ্যন্তরে সন্ত্রাস ছড়িয়েছে, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে। এই লেখায় বালুচিস্তান সমস্যাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে, যাতে পাঠকের মনে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কেন পড়া উচিত “বালুচ দস্তাবেজ”?

1. একটি গোপন ইতিহাসের উন্মোচন: বালুচিস্তান বিষয়ে যা বলা হয়, তার চেয়েও বেশি কিছু এই বইয়ে দেখানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রচারের আড়ালে থাকা সত্য ঘটনাগুলোকে কল্পনার ছাঁচে বাস্তবের মতো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
2. উপন্যাস নয়, এক ঐতিহাসিক নথি: এটি শুধুমাত্র সাহিত্য নয়, এটি একটি দস্তাবেজ—যেখানে ইতিহাস, রাজনীতি, নির্যাতন ও প্রতিরোধের কাহিনি পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে। যারা ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবেন, তাঁদের জন্য এটি এক অমূল্য সংযোজন।
3. প্রচলিত ধারার বাইরে সাহসী কণ্ঠস্বর: বইটি এমন সব প্রশ্ন তোলে, যা অধিকাংশ লেখক এড়িয়ে যান। সন্ত্রাস, ধর্মীয় চরমপন্থা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং গ্লোবাল পাওয়ার পলিটিক্স নিয়ে লেখিকা যেভাবে সরাসরি কথা বলেছেন, তা বিরল।
4. ভারতের ভূ-রাজনীতিতে বালুচিস্তানের প্রভাব বুঝতে সহায়ক: এই বই ভারতের পাঠকদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বালুচ সমস্যা যে কেবল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নয়, বরং ভারতের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক অবস্থানের সঙ্গেও যুক্ত—এই দৃষ্টিকোণটি বিস্তারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
5. সহজ ভাষায় কঠিন বিষয়: কঠিন রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলোও এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে সাধারণ পাঠকের পক্ষেও অনায়াসে বোঝা সম্ভব। এটা বইটির বড় সম্পদ।
6. মানবাধিকার, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার গল্প: বালুচিস্তানের সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা, সংগ্রাম এবং স্বপ্নের যে করুণ চিত্র উঠে এসেছে, তা পাঠককে মানবিকভাবে নাড়িয়ে দেবে।

সহজ-সরল ভাষায় রচিত এই গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠকের কাছে বালুচিস্তানের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে এক ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।