ভারতে আধুনিক শিল্পকলার নারীবিশ্ব: রঙের মধ্যে প্রতিবাদের অনুরণন
নারী যখন তুলির মুখে নিজের আত্মজিজ্ঞাসা রেখে যায়, তখন তা শুধুমাত্র একটি শিল্পকর্ম নয়, হয়ে ওঠে ইতিহাসের দলিল।

‘ভারতে আধুনিক শিল্পকলার নারীবিশ্ব’ এমনই এক দীর্ঘ, বহুস্তর বিশ্লেষণাত্মক যাত্রা—যেখানে শিল্পের ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া, অবজ্ঞাত বা অবদমিত নারী শিল্পীদের কণ্ঠস্বরকে তুলে আনা হয়েছে সংবেদনশীল, গবেষণাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।

বইটি তিনটি বিস্তৃত পরিসরের মধ্যে গড়ে উঠেছে:

১. ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

উনিশ শতকের শেষদিক থেকে ভারতীয় সমাজে যে নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তার মধ্যে নারীশিক্ষা, নারীর স্বাধীনতা এবং সৃজনশীলতার জায়গা কোথায় ছিল—সেই প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, নারীরা কীভাবে শিল্পচর্চার পরিসরে প্রবেশ করলেন, এবং সেই প্রবেশ কতখানি বাধাহীন ছিল।

২. শিল্পীদের জীবন ও কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পভাবনা থেকে শুরু করে জয়নুল আবেদিন, অমৃতা শেরগিল, বিমলা বাজোরিয়া, আর্ট কলেজে প্রথম নারী শিক্ষার্থী, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাঁদের অবদান—এই বইয়ে বিস্তৃতভাবে উঠে এসেছে।

নারীরা কী আঁকতেন? কীভাবে তাঁদের বিষয় নির্বাচিত হত? নারীদেহ যখন নারী শিল্পীর চোখে উঠে আসে, তখন তা কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক শিল্পচর্চাকে চ্যালেঞ্জ করে—এই প্রসঙ্গগুলি যুক্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

৩. আঞ্চলিকতা ও তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ

বিশেষ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশে নারী শিল্পীদের পথপরিক্রমা, যেমন: ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, বেগম শারমিন কবির, সুলতানা জামানদের মতো শিল্পীদের অবদান।

তেমনি ইউরোপে নারী শিল্পীদের ইতিহাসও তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, কীভাবে পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট একে অপরের থেকে ভিন্ন, আবার কোথাও কোথাও একে অন্যকে প্রতিফলিত করে।

এই গ্রন্থের বিশেষত্ব:

1. একবিংশ শতাব্দীর শিল্পসমাজে নারীর অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতার বিশ্লেষণ
2. লোকচিত্র ও হস্তশিল্পের জগতে নারীদের অনুচ্চারিত অবদান
3. পিতৃতন্ত্র ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার টানাপোড়েন
4. আত্মপ্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে উঠে আসা এক মৌন আন্দোলনের দলিল

এই বই শুধুমাত্র শিল্প ইতিহাসের পঠন নয়—এ এক অন্তর্দৃষ্টি, এক আলোকপাত, এবং এক নীরব সংগ্রামের দলিল যা রঙ, রেখা, দাগ আর অবকাশ দিয়ে লেখা হয়েছে। যাঁরা শিল্প, লিঙ্গ, সমাজ ও ইতিহাসের ছেদবিন্দুতে আগ্রহী, তাঁদের কাছে এটি হতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক, গবেষণার সহায়ক গ্রন্থ কিংবা নান্দনিক উপলব্ধির এক নতুন দ্বার।