“আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যেরে...” — এই গানের পংক্তির মধ্য দিয়েই শুরু হয় এক অন্তহীন পথচলার যাত্রা, যা বাউল দর্শনের অন্তরকথা।

এই বইটি বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘বাউল’ সম্প্রদায় ও তাদের ধর্ম-দর্শনের উপর একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণামূলক রচনার সংকলন। বাউল কেবল একটি সংগীতধারা নয়, এটি একটি জীবনদর্শন, একটি মানবতাবাদী ধর্মীয় পথ। জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের সীমার বাইরে দাঁড়িয়ে বাউলরা খোঁজে সেই ‘মনের মানুষ’—যিনি দেহেই বিরাজমান। ঈশ্বরতত্ত্ব, জন্মান্তর বা পরলোক নয়, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশই বাউল সাধনার মূল উদ্দেশ্য।

গ্রন্থটিতে বাউল দর্শনের উৎপত্তি, বিকাশ, ও এর মূল মানবতাবাদী চেতনার দিকগুলি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বাউল সাধনার মূল দর্শন—লোকায়ত চিন্তাধারা, অন্তর্মুখী ঈশ্বর সন্ধান, এবং 'সোনার মানুষ' নির্মাণের আহ্বান—সমকালীন সমাজে এর প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে প্রাঞ্জল ভাষায়।

বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে মরমী সাধক ফকির লালন শাহ-র জীবন ও দর্শন নিয়ে। লালন শাহ হিন্দু না মুসলমান, তাঁর জন্মস্থান কোথায়—তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাঁর চিন্তা ও সাধনার সার্বজনীনতা আজও প্রভাবিত করে চলেছে গোটা উপমহাদেশের লোকধর্মকে। তিনি ছিলেন একাধারে আধ্যাত্মিক সাধক, সমাজ সংস্কারক এবং একজন দার্শনিক। সুফি, বৈষ্ণব ও লোকজ ধারার সমন্বয়ে গঠিত তাঁর সাধনপথ বাংলা সংস্কৃতিতে এক অনন্য ঐতিহ্য রচনা করেছে।

এই গ্রন্থটি বাউল ও লালন-ভাবনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, দার্শনিক ভিত্তি ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে আগ্রহী পাঠক, গবেষক, এবং লোকসংস্কৃতি অনুরাগীদের জন্য একটি অপরিহার্য পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া এই লোকধর্ম, তার দর্শন ও সংগীতের মাধুর্য আজকের সামাজিক বিভাজনের যুগে এক গভীর মানবিক বার্তা বহন করে—যা নতুন করে পাঠ ও মননের দাবি রাখে।

সময়োপযোগী, মননশীল এবং তথ্যসমৃদ্ধ এই সংকলন পাঠককে নিয়ে যাবে বাংলার আদি অন্তরের সাধনার পথে—যেখানে মানুষই ধর্ম, আর প্রেমই পরমার্থ।