মুঘল যুগের দর্পণে যদুনাথ: ইতিহাসচর্চার নির্বাচিত দৃষ্টিকোণ

মুঘল যুগের বিস্তৃত ইতিহাস নিয়ে একাডেমিক চর্চা যেমন বিশাল, তেমনি সাধারণ পাঠকের কাছে সেই ইতিহাস প্রায়শই রয়ে যায় অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। এই গ্রন্থ ঠিক সেই ব্যবধানই মেটাতে চায়। উদ্দেশ্য স্পষ্ট—মুঘল যুগ (১৫২৬–১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে একটি প্রাথমিক, অথচ সুসংহত ধারণা নির্মাণ, যা সহজবোধ্য ভাষায় পাঠকের মনে ইতিহাসচেতনার ভিত্তি তৈরি করে।

গ্রন্থের সূচনায় দেওয়া হয়েছে আকবর ও আওরঙ্গজেবের শাসনামলের মুঘল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তৃতি নির্দেশক দুটি মানচিত্র। পাঠক তাই ইতিহাসের আলোচনায় প্রবেশের আগেই চাক্ষুষ অনুধাবনে সক্ষম হন এক সাম্রাজ্যের রূপ ও পরিধি।

এই সংকলনের মূল মেরুদণ্ড গঠন করেছেন ইতিহাসবিশারদ স্যার যদুনাথ সরকার। বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার এক অন্যতম প্রভাকর, যাঁর দীর্ঘ চার দশকের প্রবন্ধচর্চা থেকে নির্বাচন করা হয়েছে ২১টি নির্যাসপ্রাপ্ত রচনা। 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'মানসী', 'শিক্ষক' ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধগুলি পাঠককে নিয়ে যাবে সমসাময়িক আলোচনার ভেতর দিয়ে একটি শাসনযুগের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে—যা কেবল রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিসরেও বিস্তৃত।

গ্রন্থের আকর্ষণীয় দিক হল এর পরিশিষ্টসমূহ—যা ইতিহাসকে কেবল যদুনাথের দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ না রেখে আরও বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে যায়। অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা, রামপ্রাণ গুপ্ত প্রণীত নির্বাচিত অংশ এবং পঙ্কজকুমার দত্তের মুঘল আমলের তোপ সংক্রান্ত রচনা—সব মিলিয়ে পাঠক পেয়ে যান বহুস্তরীয় দৃষ্টিভঙ্গি।

পূর্বভাষণে স্যার যদুনাথের জীবন, ইতিহাসদর্শন ও গবেষণাকর্মের যে সংক্ষিপ্ত অথচ সুস্পষ্ট পর্যালোচনা করা হয়েছে, তা পাঠকের কাছে একজন ইতিহাসবিদের চিন্তা ও কাজের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে, যা গোটা গ্রন্থপাঠকে আরও পরিপূর্ণ করে তোলে।

এই গ্রন্থ কেবল একটি ইতিহাসের পাঠ নয়, বরং ইতিহাসচর্চার একটি পাঠও বটে—যেখানে নিখুঁত তথ্যনিষ্ঠতা, ভাষার শৃঙ্খলাবদ্ধ সৌন্দর্য ও বিশ্লেষণধর্মী মননের সম্মিলন ঘটেছে। ইতিহাস যদি এক বিস্তৃত মানচিত্র হয়, তবে এই গ্রন্থ সেই মানচিত্রে পাঠকের জন্য আঁকে এক নিখুঁত পথরেখা।