তসলিমা নাসরিনের "আমার মেয়েবেলা" কেবল তাঁর ব্যক্তিগত শৈশবের গল্প নয়, বরং তা একটি সমাজ ও সময়ের দলিল। ময়মনসিংহ শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা, পরিবারে নারীদের অবস্থান, সমাজের সংকীর্ণতা, এবং ধর্মীয় ইস্মালিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর ভেতর জন্ম নেওয়া প্রশ্ন ও বিদ্রোহ – সবকিছুই বইটির মূল উপজীব্য।

এই গ্রন্থে আমরা দেখি একজন ছোট মেয়ে কীভাবে ধীরে ধীরে নিজেকে চিনতে শেখে, প্রশ্ন করতে শেখে, এবং নিজের মত গড়ে তোলে – যা তাঁকে ভবিষ্যতে একজন লেখক ও প্রতিবাদী কণ্ঠে রূপান্তরিত করে।

গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও বিশ্লেষণ:

১. শৈশবের বাড়িঘর ও পরিবার:

তসলিমা একটি শিক্ষিত পরিবারের সন্তান হলেও, সেখানে নারী-পুরুষ বৈষম্য স্পষ্ট। মা ছিলেন ঘরবন্দি, পিতার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। লেখিকা ছোটবেলা থেকেই এই অসমতা উপলব্ধি করতে থাকেন।

২. স্কুলজীবন ও বন্ধুত্ব:

বিদ্যালয়ে পড়াকালীন নানা বৈষম্য, মেয়েদের প্রতি আলাদা আচরণ, এবং যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতাও তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন। এই অধ্যায়গুলোতে সমাজের গোপন বাস্তবতা ফুটে ওঠে।

৩. প্রেম, শরীর ও আত্মপরিচয়:

তসলিমা নিজের শরীর ও আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেন কৈশোরে। ধর্ম ও সমাজ যেখানে নারীর শরীরকে লজ্জার বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে, সেখানে তিনি প্রশ্ন তোলেন: কেন নারীর অনুভবকে চেপে রাখা হবে?

৪. ধর্ম ও দ্বিধা:

একটি মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা তসলিমা ধর্মীয় রীতি-নীতিকে কাছ থেকে দেখেছেন। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস, নারীদের প্রতি বৈষম্য, ও অমানবিক আচরণ তাঁর মনে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। বইতে তিনি দ্বিধা ও বিরোধিতার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটান।

৫. মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও লেখালেখির শুরু:

শেষ দিকে আমরা দেখি কীভাবে লেখালেখির মধ্য দিয়ে তিনি নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পান। এই লেখালেখিই পরবর্তীকালে তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

বইটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

• এটি একটি নারী-জীবনের নির্ভীক দলিল।
• সমাজের গোপন ও নিষিদ্ধ চিত্রকে সামনে আনে।
• নারীর অধিকার, স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয় নিয়ে আলোচনার পথ তৈরি করে।
• সাহসী, সরল ও তীক্ষ্ণ ভাষায় লেখা – যা পাঠকের মনে দাগ কাটে।

আমার মেয়েবেলা এমন একটি বই, যা একাধারে আত্মজৈবনিক এবং রাজনৈতিক। এটি সাহসিকতার সঙ্গে বলা এক নারীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিদ্রোহের কাহিনি। তসলিমা নাসরিন নিজের যন্ত্রণার কথা বললেও, সেটি কেবল তাঁর একার নয় – তা অনেক নারীর, বহু সমাজের অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি। যারা আত্মজীবনী, সমাজচেতনা, নারীবাদ, এবং মুক্তচিন্তার বই পড়তে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য এই বইটি অবশ্যপাঠ্য।

প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ – ১৯৯৯

বর্তমান সংস্করণ  –  ২৫তম