"উতলা হাওয়া"  তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী-চক্রের দ্বিতীয় খণ্ড, যেখানে তিনি তাঁর কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের শুরু, বিশ্ববিদ্যালয়জীবন, চিকিৎসা পেশায় প্রবেশ এবং ক্রমে একজন সাহসী লেখিকা হয়ে ওঠার যাত্রাপথ তুলে ধরেছেন। এই বইটি সেই তরুণী তসলিমার গল্প, যিনি শুধু নিজেকে গড়ে তোলেননি, বরং সমাজ, ধর্ম এবং প্রথাগত চিন্তার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছেন।

নামটি নিজেই এক প্রতীক – “উতলা হাওয়া” মানে অস্থির, বিক্ষুব্ধ বাতাস। এই গ্রন্থে লেখিকার জীবনও যেন এক উতলা হাওয়ার মতোই – চঞ্চল, বিদ্রোহী এবং পরিবর্তনের বার্তাবাহী।

উতলা হাওয়া শুরু হয় একটি তরুণ নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, যে চারপাশের অবিচার, বৈষম্য, এবং জড়তা দেখে নীরবে বসে থাকতে পারে না। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, মেডিকেল কলেজে ভর্তি, এক পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল সমাজে একজন নারী হিসেবে টিকে থাকা – সব কিছুই এখানে খুব সাবলীলভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর প্রেম, বিয়ে, সংসার, এবং ধীরে ধীরে লেখালেখির জগতে প্রবেশ, এই সবকিছুই পাঠককে এক গভীর অনুভবের মধ্যে নিয়ে যায়।

গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও বিশ্লেষণ:

১. বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের অভিজ্ঞতা:

তসলিমা ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার সময় যে পরিবেশে ছিলেন, তা ছিল ভীষণ রক্ষণশীল। মেয়েদের প্রতি হীনমন্যতা, যৌন হয়রানি, এবং শিক্ষার নামে শৃঙ্খলার চাদরে ঢেকে রাখা নিষ্ঠুর নিয়মগুলো তাঁর চোখে পড়ে এবং তিনিও এর বিরুদ্ধে কলম ধরেন।

২. প্রেম ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক:

এই অধ্যায়গুলোতে তসলিমা তাঁর ব্যক্তিগত প্রেম ও বিয়ে নিয়ে অকপট আলোচনা করেছেন। ভালোবাসা ও সম্পর্কেও সমাজের দ্বিচারিতা কীভাবে নারীর কাঁধে সব দোষ চাপিয়ে দেয়, তা এখানে স্পষ্ট।

৩. লেখালেখির শুরু ও প্রতিবাদের ভাষা:

তাঁর কবিতা ও গদ্যের মধ্যে যে প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিল, সেটি প্রথম দিকে বহু পাঠক পছন্দ করলেও, পরবর্তীতে সেই কণ্ঠই তাঁকে বিতর্কিত করে তোলে। তবে তসলিমা নিজের আদর্শ ও মতাদর্শ থেকে কখনও পিছপা হননি।

৪. ধর্ম ও সমাজ নিয়ে প্রশ্ন:

ধর্মীয় কুসংস্কার, নারী দমন ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখিকার প্রশ্ন তুলবার সাহস এ অধ্যায়গুলোতে বারবার দেখা যায়। এতে তিনি শুধু একজন নারীবাদী নন, বরং একজন মুক্তমনা চিন্তাবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

কেন পড়বেন ‘উতলা হাওয়া’?

• এটি তসলিমা নাসরিনের ব্যক্তিগত সংগ্রামের কাহিনি, যা একসময়ে সমগ্র বাংলার প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।
• সমাজ ও সংস্কৃতির মোড়লদের মুখোশ উন্মোচনের সাহসী প্রচেষ্টা।
• নারীর আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতা নিয়ে দারুণ দৃষ্টিভঙ্গি।
• ভাষা সহজ, সাবলীল এবং আবেগে ভরপুর – যা পাঠককে আকৃষ্ট করে।

প্রথম প্রকাশ – ২০০২

বর্তমান সংস্করণ – ১৪-তম

উতলা হাওয়া কেবল একটি আত্মজীবনী নয় – এটি একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ, একটি নারীর আত্মজাগরণ, একটি সমাজ-সমালোচনার সাহসী দলিল। তসলিমা নাসরিন যেভাবে নিজের অভিজ্ঞতাকে লেখায় রূপ দিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন।