"নদিয়া চলে চলে রে ধারা"—এই শান্ত গানের মতো নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নিষ্ঠুর, রক্তমাখা বাস্তবতা। গণ্ডক নদীর বহমান স্রোতের মতোই এগিয়ে চলে অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সত্যাশ্রয়ী থ্রিলার, যেখানে প্রবাহিত হয় অপরাধ, প্রতিহিংসা ও মৃত্যুর ঘূর্ণি।

পূণ্যভূমি বেতিয়া। নেপাল সীমান্তের ধারে অবস্থিত এই অঞ্চল, গণ্ডক নদীর আঁচলে জড়ানো। নেপালের বুক চিরে আসা এই নদী শুধু ভূগোল নয়, বহন করে বাস্তব ইতিহাস—যেখানে নদীপথেই ঢুকে পড়ে বিদেশি পণ্য, অস্ত্র, মাদক। রাতের আঁধারে, শীতল জলে, নৌকোয় পেরিয়ে আসে কালো টাকার মাল। এই চোরাপথ, এই সীমান্তজুড়ে গড়ে ওঠে এক সমান্তরাল দুনিয়া। আশির দশকের শেষভাগে উত্তর বিহারের এই অঞ্চল রূপ নেয় এক ডার্ক ওয়ার্ল্ডে—যেখানে শাসন করে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মাফিয়া গ্যাং।

সেই গ্যাং-সংঘর্ষের রক্তাক্ত সময়ের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী, লেখকের বাল্যসুহৃদ লায়লা বস, ওরফে লখবিন্দর সিং। একদা কোলবেল্টের দুর্ধর্ষ ও অবিসংবাদী গ্যাংস্টার ডন, যার জীবনের প্রতিটি বাঁকে জড়িয়ে আছে খুন, ষড়যন্ত্র, আর মৃত্যুর অঙ্ক কষার নির্মম খেলা। এই বইয়ের কেন্দ্রীয় আখ্যান ঠিক কল্পনার অবলম্বনে গড়া নয়। বরং এটি এক বাস্তব ব্যক্তিত্বের মুখে শোনা ঘটনাপরম্পরার পুনর্গঠন—যা আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় তৎকালীন উত্তর বিহারের জ্বলন্ত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মুখোমুখি। সেই প্রেক্ষাপটে আইনের নড়বড়ে গতি, প্রশাসনের অসহায়তা, এবং অপরাধের নির্মম আধিপত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে প্রতিশোধ হয় শেষ কথা, আর হিসেব-নিকেশ লেখা হয় মৃত্যু দিয়ে।

গণ্ডক বেতিয়ার প্রাণ। কিন্তু সেই প্রাণধারায় যখন ঢেউ তোলে শোণিতস্রোত, তখন তা হয়ে ওঠে এক ভয়াবহ উপাখ্যান।

"নদিয়া চলে চলে রে ধারা" কেবল একটি থ্রিলার নয়—এ এক সময়ের দলিল, এক অন্ধকার বাস্তবতার মেটাফোর। বাংলা সাহিত্যের পরিসরে এমন বাস্তবভিত্তিক অপরাধগাঁথা, এমন নির্লজ্জভাবে নগ্ন হিংসার বিবরণ আগে কখনও আসেনি।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এই উপন্যাস পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে সেই সীমান্তবর্তী রক্তাক্ত, নৈরাজ্যপ্রবণ ভূখণ্ডে—যেখানে নদী বইছে, কিন্তু তার ধারায় কখনও কখনও শুধু জল নয়, বয়ে চলে রক্ত, প্রতিশোধ আর ভয়।