ভারতীয় সমাজে মহেশ্বর দেবতাকে লিঙ্গরূপে পূজিত হয়ে আসা দেখা গেছে মহা অতীতকাল থেকে। তাঁর ইতিহাস ও বিজ্ঞাননির্ভর সন্ধান এই গ্রন্থে উপস্থাপন করা হয়েছে। শিবকে সরল, অনাড়ম্বর, উপচারহীন, স্পর্শদোষরহিত ও আচণ্ডালের দেবতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। গাঁজাখোর, ভূতপ্রেত পরিবৃত শ্মশানচারী হিসেবে শিবের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অন্যান্য দেবতার তুলনায় শিবের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা বিভিন্ন সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। জ্যোতির্লিঙ্গের ব্যাখ্যা, তার প্রাচীন ইতিবৃত্ত এবং গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া শিবের ভস্ম, জটা, বাঘছাল, চন্দ্র, সর্প, রুদ্রাক্ষ, সিদ্ধি, গাঁজা প্রভৃতি উপাদানের বর্ণনাও প্রদান করা হয়েছে। শিবের আদিরূপ রুদ্র থেকে বর্তমানের ভোলেবাবা পর্যন্ত এক ধারাবাহিক আলোচনায় বইটি সমৃদ্ধ করা হয়েছে।

শুধুমাত্র ধর্মীয় বা সামাজিক ব্যাখ্যার বাইরে, সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শিবলিঙ্গের বহুবর্ণ ও বিচিত্র ছবিগুলোর সংযোজন গ্রন্থটিকে বিশেষ করেছে। শিবলিঙ্গের প্রকারভেদের বিস্তারিত বিশ্লেষণ একটি অধ্যায়ে উপস্থাপিত হয়েছে। পাশাপাশি লিঙ্গপূজনের উদ্দেশ্য ও ফলাফল নিয়ে গভীর শাস্ত্রালোচনা দ্বারা গ্রন্থটি সম্পূর্ণতা লাভ করেছে।

বাংলা ভাষায় শিব সম্পর্কিত পূর্ববর্তী প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহ যেমন হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের "হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ", জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পঞ্চোপাসনা", নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের "ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস" এবং বিভিন্ন শৈব পুরাণ পড়া হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক চিন্তাধারার নিরিখে শিব ও তাঁর উপাসনার প্রতীক নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক সাহিত্য বাংলায় অপর্যাপ্ত ছিল। সেই শূন্যস্থান পূরণের কাজে আলোচ্য বইটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হয়েছে।

অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়-কৃত ‘মুখবন্ধ’ এবং লেখকের সংক্ষিপ্ত ভূমিকা প্রদানের পর বিভিন্ন প্রসঙ্গ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। সরাসরি প্রবন্ধের পরিবর্তে সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনার সূত্র ধরে রচনাগুলো সাজানো হয়েছে।

প্রথম অধ্যায়—

১. অমরকণ্টক ভ্রমণ

২. প্রাগৈতিহাসিক পর্ব

৩. সিন্ধু সভ্যতা

৪. আর্য সভ্যতা

৫. কৈলাস ও জ্যোতির্লিঙ্গ প্রসঙ্গ

৬. দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ

৭. পৌরাণিক যুগ

৮. ভ্রমণ অমরকন্টক (পরবর্তী অংশ)

৯. শৈব ধর্ম: কেশী মুনি ও পাশুপত

১০. দক্ষিণ ভারত ও কাশ্মীরের শৈব সম্প্রদায়

১১. কপিলধারায়

দ্বিতীয় অধ্যায়—

১) ওংকারেশ্বর ভ্রমণ

২) অসুর

৩) ধাবড়ি কুণ্ড ভ্রমণ

৪) ওংকারেশ্বরে ফিরে এসে

৫) শিবলিঙ্গের প্রকারভেদ ও মাহাত্ম্য

৬) উজ্জয়িনীতে

৭) বঙ্গদেশের ইতিহাস— এই নিবন্ধটি সুখপাঠ্য হলেও এ-বইয়ে একেবারেই প্রক্ষিপ্ত;

৮) মহাকালের সম্মুখে।

গ্রন্থপঞ্জি, নির্দেশিকা, অসংখ্য স্কেচ ও মানচিত্রের পাশাপাশি আর্টপ্লেটে ছাপা রঙিন ছবিও সংযুক্ত করা হয়েছে।

সর্বোপরি, শিব সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক যেকোনো পাঠকের জন্য এই বইটি অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচিত। যদিও ‘আর্য সভ্যতা’ ইত্যাদি ধারণার প্রয়োগ এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়, বইটির ভাষা ও ভঙ্গিমায় ব্যক্তিগত ভ্রমণের কাঠামোতে ভক্তির বদলে খোলা মন ও সরসতা প্রদর্শন করা হয়েছে, যার ফলে পাঠকরা বিরক্ত না হয়ে এক স্নিগ্ধ ও জ্ঞানবর্ধক অভিজ্ঞতা লাভ করবেন।

"ওঁ নমঃ শিবায়" বলা হোক বা না বলা হোক, এই চমৎকার গ্রন্থটি পড়া না হলে তা দুঃখের বিষয় বলে মনে করা হয়।