মন্দ মেয়ের উপাখ্যান: একটা সমাজ, কিছু মেয়ের গল্প, আর কিছু না বলা সত্য

বইয়ের নাম আর প্রচ্ছদ দেখলেই অনুমান করা যায়—এই বইটি ‘মন্দ মেয়ে’দের জীবন নিয়ে, যাদের সমাজ ‘বারবনিতা’ নামে আখ্যায়িত করে। প্রফুল্ল রায় এই বইয়ে তুলে এনেছেন সেই নারীদের কথা, যাদের আমরা প্রায়শই অবজ্ঞা করি, ভুলে যাই যে তারাও মানুষ—তাদেরও থাকে প্রেম, স্বপ্ন, মায়া ও নীতিবোধ। বইটিতে সংকলিত হয়েছে লেখকের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বারবনিতাদের নিয়ে লেখা ১২টি ছোটগল্প ও একটি নভেলা। ভূমিকার শুরুতেই লেখক স্বীকার করেছেন—এই গল্পগুলোর পেছনে রয়েছে সমাজের নির্মম বাস্তবতা, যেখানে অনেক ‘ভালো’ মেয়ে সামাজিক বাধ্যবাধকতায় ‘মন্দ’ হয়ে ওঠে।

উল্লেখযোগ্য কিছু গল্পের ছোঁয়া:

• ‘রাজপুত’: এক বারবনিতা ও এক রাজপুত যুবকের প্রেম, আর তার ‘রাজপুত’ হয়ে ওঠার আত্মিক উন্মোচন।
• ‘জুহু বিচের সেই মেয়েটা’: এক মায়ের দারিদ্র্য তাকে কিভাবে ঠেলে দেয় দেহব্যবসায়—তা হৃদয়বিদারকভাবে উপস্থাপিত।
• ‘নরক’: বারবনিতাদের পাড়া যে ভালোবাসা, দায়িত্ব ও নীতিবোধে স্বর্গে রূপ নিতে পারে—এই গল্প তার প্রমাণ।

অন্যান্য গল্পগুলোতেও উঠে এসেছে প্রেম, প্রতারণা, আত্মোপলব্ধি, সামাজিক উৎপীড়ন, ও একেকটি নারীর মানবিক রূপ।

কেন পড়বেন?

• মানুষের অন্তর্বাসে সাদা আলো: লেখক দেখিয়েছেন, ধূলিমাখা জীবনের মাঝেও বারবার যেন জ্বলে ওঠে একটি আলোর ঝলকানি; “এই সব মেয়ের মধ্যেও … মনুষ্যত্ব একেবারে বিলীন হয়ে যায় নি, বরং … অসামান্য স্ফুরণ ঘটে” ।
• সহানুভূতির ভাষা: পাঁকে ঢাকা জীবনের আড়ালে বসে থাকা ‘মন্দ মেয়ে’দের প্রতি লেখকের সহানুভূতিশীল দৃষ্টি পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করে।
• সামাজিক প্রতিবাদ: বইটি ও সমাজে অচেনা এক শ্রেণিকে মানুষের দৃষ্টিতে আনতে সহায়তা করে—‘মন্দ’ শব্দের মাঝে নিহিত মানবতা তুলে ধরে।

বইটির বিশেষত্ব:

প্রফুল্ল রায় চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন বারবনিতা সমাজের এক খণ্ড বাস্তবতা — তাদের নিত্যদিনের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার আকুতি, স্বপ্ন ও নিজস্ব মর্যাদাবোধ। পাঠক যেন চোখের সামনে দেখতে পান একেকটা ঘর, যার দরজার আড়ালে থমকে থাকে জীবন, অথচ ভিতরে গুনগুন করে ওঠে মানুষ হওয়ার আকুতি।

এই বই সহানুভূতির পাঠ তৈরি করে, সমাজব্যবস্থার প্রতি একধরনের প্রশ্ন তোলে এবং ‘মন্দ মেয়ে’দের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে তোলে। এটি এমন এক সাহিত্যিক প্রচেষ্টা, যা পাঠককে কেবল গল্প শুনিয়ে থামায় না—ভাবায়, নাড়ায়।

সীমাবদ্ধতা:

যদিও বইটি বারবনিতা সমাজের মানবিক চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম, তবে কিছু পুনরাবৃত্তি ও একই প্লটে গল্প বলার প্রবণতা পাঠককে কিছুটা একঘেয়ে করতে পারে। বেশ কয়েকটি গল্পেই বারবার দারিদ্র্য-নির্ভর ব্যাকগ্রাউন্ড, এবং একই ধরনের ‘পবিত্রতার ভিতরেও বন্দী’ চরিত্রচিত্রণ কিছুটা কল্পনাবিলাসের মতো ঠেকে। ফলে বইটি পুরো সমাজব্যবস্থার সব দিককে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি—বরং কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ‘মন্দ মেয়ে’র গল্পেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।