জীবনের রূপ দর্শন করতে বেরিয়েছিলেন তিনি—গৌরকিশোর ঘোষ। লক্ষ্য ছিল শুধু বাইরের দৃশ্যাবলি নয়, বরং সেই দৃশ্যের অন্তরালে থাকা গভীর মানসপ্রবাহ, মানুষের মনোজগৎ, অস্তিত্বের টানাপোড়েন, সংকট ও সম্ভাবনার অনির্বচনীয় অনুভব। দেখা তাঁর কাছে ছিল বহুস্তরীয় অভিজ্ঞতা—চোখ দিয়ে, মন দিয়ে, বোধ দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা। 

নিজেই একবার বলেছিলেন, “দিন রাত্তির সতর্ক চোখে ঘুরেছি। যা দেখেছি, যেটা ভাল লেগেছে, তুলে ধরেছি…”—এই সরল স্বীকারোক্তির মধ্যেই ধরা পড়ে তাঁর জীবন ও সৃষ্টির মূল চালিকাশক্তি। ‘রূপদর্শী’ ছদ্মনামে তিনি যে সব লেখা রচনা করেছিলেন, তা নিছক রম্যরচনা নয়। কখনও সেগুলো নক্‌শা, কখনও রসিক ঝাঁকিদর্শন, কখনও সামাজিক ভাষ্য, আবার কখনও কখনও হয়ে উঠেছে ত্রিকালদর্শিতার গভীর মর্মবাণী। তাঁর নক্‌শায় যেমন থাকে রেখার খেলা, তেমনি থাকে জীবন দেখা এক অন্তর্মুখী অভিজ্ঞতা। শুরু করেছিলেন নক্‌শার ঝাঁপি হাতে, কিন্তু ধীরে ধীরে ভাষ্যকারে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। সংবাদের রূপ বোঝা এবং তাকে ভাষ্যে রূপান্তর করা ছিল তাঁর দক্ষতা ও দায়িত্ব। নক্‌শা হোক বা ভাষ্য, সর্বত্রই তিনি ছিলেন জীবনরসিক, রঙ্গ-ব্যঙ্গের ধারালো পর্যবেক্ষক এবং একজন সত্যানুসন্ধানী লেখক।

এই সংকলন ‘রূপদর্শী সংগ্রহ ১ ’-এ সেই রচনাগুলির নির্বাচিত সংগ্রহ স্থান পেয়েছে, যা একাধারে মজার, তীক্ষ্ণ, সজাগ এবং চিন্তামূলক। সংকলিত রচনাগুলির মধ্যে আছে—রূপদর্শীর নক্‌শা, সার্কাস, নাচের পুতুল, রূপদর্শীর রঙ্গ-ব্যঙ্গ, জলবত্তরলম্‌, কথায় কথায়, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, মনে পড়ে, ব্রজদার গুল্পসমগ্র এবং বিবিধ রচনা। এই রচনাগুলি পাঠকের সামনে তুলে ধরে জীবনের বহুমাত্রিক রঙ, অসংখ্য সুর, ছায়া ও ব্যঙ্গের প্রতিচ্ছবি—যেখানে আমরা নিজেরাই প্রতিবিম্বিত হই।

লেখক পরিচিতি:

গৌরকিশোর ঘোষ  জন্মগ্রহণ করেন ২২ জুন ১৯২৩ (৫ আষাঢ় ১৩৩০), অবিভক্ত বাংলার যশোহর জেলায়। তাঁর শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি শ্রীহট্ট জেলার একটি চা বাগানে। পরে পড়াশোনা করেন নবদ্বীপে এবং ১৯৪৫ সালে আই.এস-সি. পাশ করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন ছিল বহুবর্ণ পেশার অভিজ্ঞতায় ভরা—প্রাইভেট টিউটর থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁর বয়, খালাসি, বিমা এজেন্ট, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক, মুদ্রাক্ষরিক, সাংবাদিক—আরও কত কী! এই বিচিত্র জীবনের অভিজ্ঞতাই তাঁকে করে তুলেছিল জীবনজিজ্ঞাসায় পরিপূর্ণ ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এক লেখকে।

১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় MISA (Maintenance of Internal Security Act)-তে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, এবং এক বছর পর মুক্তি পান। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে তাঁকে অসংখ্যবার নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই অটল সংগ্রামের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পান দক্ষিণ কোরিয়ার কো জয় উক স্মৃতি পুরস্কার (প্রথম প্রাপক), আনন্দ পুরস্কার (১৯৭০), র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৮১) এবং বঙ্কিম পুরস্কার (১৯৮২)।

তাঁর প্রয়াণ ঘটে ১৫ ডিসেম্বর ২০০০। কিন্তু সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে তাঁর প্রস্থান একেবারেই সমাপ্তি নয়—তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে তিনি আজও জীবন্ত।