যেদিন ঘোষিত হল র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, সেদিন কলকাতায় এসেই প্রথম যে খবর পৌঁছেছিল গৌরকিশোর ঘোষের কাছে, তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমী স্থানে—বাঙালি মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে, প্রধান অতিথি হিসেবে। এই সম্মেলন স্বাধীনতার এত বছর পর প্রথমবার আয়োজিত হয়েছিল কলকাতায়, সেই উদ্দেশ্যেই—মুসলিম জীবনের প্রতি সাহিত্যে যে দীর্ঘকালীন অবহেলা ও উপেক্ষা চলে এসেছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং বাস্তব, নিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার সাহসী প্রয়াসকে অনুপ্রাণিত করতে। এই প্রেক্ষাপটে গৌরকিশোর ঘোষই ছিলেন নিঃসন্দেহে সেই সম্মেলনের সর্বাপেক্ষা যথোচিত মুখ—কারণ তিনিই লিখেছেন মুসলমান জীবনের অন্তরঙ্গ, বিশাল ক্যানভাসে বিস্তৃত এক অনুপম আলেখ্য—‘প্রেম নেই’।

এই উপন্যাসটি তাঁর পরিকল্পিত মহাকাব্যিক ট্রিলজি ‘দেশ-মাটি-মানুষ’-এর দ্বিতীয় খণ্ড। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায় এবং প্রকাশকালেই তা তীব্র সাড়া জাগিয়েছিল।

‘প্রেম নেই’ পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হয়—লেখক যেন সফিকুল, দাউদ, গাফ্‌ফার বা শবনমদের বহুদিনের সহচর। তাদের জীবনের অন্দরমহলে প্রবেশ করেছেন তিনি, দেখেছেন গভীরভাবে তাদের দ্বন্দ্ব, সংস্কার, আকাঙ্ক্ষা, ধর্মীয় টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। গ্রাম থেকে শহর—যেখানেই হোক, তিনি যেন আমাদেরও করে তুলেছেন তাদের জীবনের একান্ত প্রতিবেশী। গল্পের বাঁকে বাঁকে উঠে আসে প্রেম, রিরংসা, সংকট, এবং এক তীব্র মানবিক আর্তনাদ—"প্রেম নেই", যা শেষ পর্যন্ত মিথ্যা প্রমাণিত হয়; কারণ এই বইয়ের গভীরে নিহিত রয়েছে প্রেমেরই অনিবার্য উপস্থিতি, যদিও তা অনেক সময় অদৃশ্য, চাপা ও বিকৃত।

এই উপন্যাস শুধু একটি সম্প্রদায়ের গল্প নয়—এ এক জাতি ও সমাজের আয়না, যেখানে যুগের সংকট, ধর্মের দ্বন্দ্ব এবং মানুষের চিরন্তন টানাপোড়েন একত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। গৌরকিশোর ঘোষ, যিনি বরাবরই ছিলেন সত্যনিষ্ঠ, যুক্তিবাদী ও মানবিক চেতনায় বিশ্বাসী, এই উপন্যাসেও তুলে ধরেছেন এক নিঃসংকোচ ও নিরপেক্ষ কণ্ঠ—যা বাংলা সাহিত্যে বিরল।

‘প্রেম নেই’ সেই বই, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজের প্রান্তে থাকা কণ্ঠগুলোর প্রতিধ্বনি না-শোনা মানেই সত্যকে অসম্পূর্ণ রাখা। এই উপন্যাস সেই অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করার এক সাহসী প্রচেষ্টা।