শুরু হয়েছিল সেই ১৯৫৯ সালে—‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় গৌরকিশোর ঘোষের প্রথম উপন্যাস ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’। পাঠকমনে চমক জাগিয়েছিল এক অনন্য ভাষাশৈলী, পরিশীলিত বাস্তবতা এবং বাংলার গ্রামীণ জীবনের গভীর, সত্যনিষ্ঠ চিত্রায়ন। কিন্তু এটিই ছিল কেবল সূচনা। সেই উপন্যাস ছিল ‘দেশ-মাটি-মানুষ’ নামে পরিকল্পিত এক মহান এপিক ট্রিলজির প্রথম খণ্ড।

এরপর আসে দ্বিতীয় খণ্ড—‘প্রেম নেই’, যার জন্য লেখক বঙ্কিম পুরস্কারে সম্মানিত হন। প্রথম দুটি খণ্ডেই গৌরকিশোর ঘোষ তুলে ধরেছিলেন বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের প্রেক্ষিতে ব্যক্তি ও সমাজের সংঘাত, গ্রামীণ জীবনের ভাঙন এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জটিল চালচিত্র।

এবার, সেই ধারাবাহিকতার শেষ সংযোজন, তৃতীয় খণ্ড—‘প্রতিবেশী’।

এই উপন্যাসে আর স্থান-কালের বাইরের কোনও সংঘর্ষ নেই; এখানে যুদ্ধ মানুষের ভিতরের, মনোলোকের। মানুষ যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে মানুষের কাছ থেকে, প্রাকৃতিক জগত থেকে, এমনকি নিজের আত্মা থেকেও—তখন সেই সংকটমুহূর্তে দাঁড়িয়ে ‘প্রতিবেশী’ পাঠককে শোনায় এক আশাবাদী প্রেমের বাণী:

"ভালোবাসো, ভালোবাসো—তোমার প্রতিবেশীকে তুমি ভালোবাসো।"

এই উপন্যাস মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের অন্বেষণ। আর এই অন্বেষণে উঠে এসেছে আত্মবিচ্ছিন্নতার বিপর্যয়, সামাজিক ও আত্মিক দূরত্ব, এবং সেই দূরত্ব কাটিয়ে ভালোবাসায় ফিরে আসার জরুরি প্রয়োজন।

তবে এটাও বুঝে নেওয়া জরুরি যে, ‘দেশ-মাটি-মানুষ’ কেবল একটি কাহিনির ধারাবাহিক বিবরণ নয়। গৌরকিশোর ঘোষ এখানে তিনটি স্বতন্ত্র পর্বের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন একক বিষয়ের—বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ঐতিহাসিক বিবর্তন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ইতিহাসের নির্যাসকে জীবনের অভিজ্ঞতায় পরিণত করা।

এই ত্রয়ীতে তিনি যে সময়পরিসর বেছে নিয়েছেন, তা ১৯২২ থেকে ১৯৪৬—বাংলার ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সময়কাল। এই পঁচিশ বছরে যে-ভাবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী থেকে গোষ্ঠীতে সম্পর্কগুলি রূপান্তরিত হয়েছে; শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থেকে বেড়ে উঠেছে সন্দেহ, দ্বন্দ্ব, এবং শেষ পর্যন্ত দেশভাগের রক্তাক্ত বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে—এই উপন্যাসত্রয়ে সেই ইতিহাসই তুলে ধরা হয়েছে জীবন্ত, সংবেদী ভাষায়।

‘প্রতিবেশী’ তাই শুধু এই ত্রয়ের সমাপ্তি নয়—এ এক সাহিত্যিক প্রতিজ্ঞার পূর্ণতা। গোষ্ঠীগত সংঘর্ষের বিরুদ্ধে মানবিকতার পক্ষে একটি বিশুদ্ধ উচ্চারণ। ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির সঙ্গে জাতিগত ইতিহাসের অপূর্ব মিশ্রণে, গৌরকিশোর ঘোষ গড়ে তুলেছেন এমন এক সাহিত্যিক ঐক্য, যা বাংলা উপন্যাসের ভুবনে আজও বিরল।