পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গ দেশবদলের স্মৃতি একটি শক্তিশালী ও স্পর্শকাতর সংকলন, যার সম্পাদনা করেছেন রাহুল রায়। এই গ্রন্থে ১২ জন পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া মানুষের স্মৃতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই বইটি দেশভাগের বিভীষিকা এবং উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা, ভীতি, এবং সহনশীলতার গভীরে প্রবেশ করে।

হাসান আজিজুল হক, বদরুদ্দিন উমর সহ বহু প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলের সাধারণ উদ্বাস্তুরা তাদের গল্প শোনান। এই বইটির মাধ্যমে পাঠকরা অনুভব করবেন কীভাবে বিভাজন, দাঙ্গা এবং নানান বিপর্যয়ের মধ্যে তাঁরা তাদের পরিচিতি, প্রতিবেশী ও জীবনযাত্রার প্রিয়তাকে হারিয়েছেন, এবং নতুন অজানা প্রান্তরে, যেমন রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকায় গিয়ে নিজেদের পুনর্নির্মাণের কষ্টকর সংগ্রাম করেছে।

সম্পাদক রাহুল রায়ের প্রারম্ভিক নিবন্ধ 'দেশভাগ ও উদ্বাস্তু প্রেক্ষিত' গ্রন্থটির শুধু নয়, বরং এই সময়ের এক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রচনা। তাঁর ভাষায়, "তবে কি স্মৃতিতে যা খুঁড়ে তোলা গেল, তা নয়, স্মরণে তাঁরা যা ফিরিয়ে আনতে চাইলেন না তার খোঁজ করাই জরুরি..." — এই চিন্তাভাবনা গ্রন্থটির বিষয়বস্তুকে আরও বিস্তৃত এবং গভীর করে তোলে।

পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গ দেশবদলের স্মৃতি একটি অসাধারণ সংকলন, যা সম্পাদকের গভীর মনোযোগ ও সজাগ মেধার প্রতিফলন। বইটির প্রচ্ছদ ও মুদ্রণও খুবই মনোযোগী এবং প্রকাশক গাঙচিলের প্রচেষ্টায় এটি আরও মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

র‍্যাডক্লিফ-রেখার আঁচড়ে দেশভাগের পরে রাতারাতি তাঁদের পিঠে পড়ে গিয়েছিল 'সংখ্যালঘু' সিলমোহর। গ্রাম-গরু-ধানিজমি, চেনা বাস্তুভিটের আনাচ-কানাচে পুরনো স্মৃতি ছড়িয়ে রেখে উদ্বাস্তু হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তাঁরা। পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গে যাত্রা করা মুসলিম সম্প্রদায়ের দেশহারা-স্মৃতির এই সংকলনে কেউ বলেছেন, 'দেশভাগ অনিবার্য ছিল', আবার কারও কথায় অনর্গল ঝরেছে আক্ষেপ, 'দেশটাকে এ ভাবে ছিঁড়ে ফেলার কি কোনও প্রয়োজন ছিল?'

পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলিমদের নিরন্তর এই পলায়নের পিছনে বাস্তবিকই কী ছিল, পড়শি-চোখগুলো রাতারাতি 'কেমন অচেনা হয়ে ওঠার ভয়' না কি তা নিছকই নব্য-পাকিস্তানের স্বপ্নকল্পের স্রোতে ভেসে পড়া? চেনা-অচেনা এমনই তেরো জনের স্মৃতি-লেখার পাশেই রইল চারটি সাক্ষাৎকারও। স্মৃতিচারণ বা এই পিছু-ফিরে দেখার একটা সহযোগী বিশ্লেষণেরও চেষ্টা করা হয়েছে এই সংকলনে। খোঁজ করা হয়েছে দেশহারা মানুষের এই স্মৃতি কি নিরপেক্ষ, এর আড়ালে কোনও স্বেচ্ছা-বিস্মরণেরও প্রশ্ন নেই তো?