শ্রীখগেন্দ্রনাথ ভৌমিকের লেখা “পদবীর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস (পরিমার্জিত ও বর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ)” বাঙালি হিন্দু সমাজে বংশগত নাম বা উপনামের উৎপত্তি, বিবর্তন ও সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্য নিয়ে রচিত এক অনন্য গ্রন্থ, যা বাংলা সাহিত্যে এক বিরল সংযোজন। শুধু নৃ-বিজ্ঞানী বা সমাজ বিজ্ঞানীদের জন্যই নয়, সাধারণ পাঠকের কৌতূহলও নিবৃত্ত করে এমন সমৃদ্ধ তথ্যভাণ্ডার এতে সংকলিত হয়েছে। 

পদবীর সূচনা কবে থেকে, কেন একটি বংশ নির্দিষ্ট উপাধি ধারণ করে, উপনাম দিয়ে জাতি নির্ধারণ কতটা যুক্তিসঙ্গত, কিংবা উপনাম পরিবর্তনের সমাজতাত্ত্বিক মাত্রা—এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সুপ্রমাণিত উত্তর লেখক সুবিন্যস্তভাবে উপস্থাপন করেছেন।

গ্রন্থটিতে বাঙালি হিন্দু সমাজের মোট ২২০টি জাতির মধ্যে ১০০টির ব্যবহৃত পদবী, খেতাব ও উপাধির এক বিস্তৃত তালিকা দেওয়া হয়েছে। তালিকাগুলি বিজ্ঞানসম্মত শ্রেণীবিন্যাসে সাজানো হওয়ায় পদবীর উৎস, বিকাশ এবং বিভিন্ন জাতির ব্যবহার সম্পর্কে এক সমগ্র ভাবনা পাওয়া যায়। একই উপনাম যে বহু জাতির মানুষ ব্যবহার করে—রায়, মুখার্জি, দত্ত প্রভৃতি—তাও স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে, ফলে উপাধির মাধ্যমে বংশের আভিজাত্য নির্ণয়ের প্রচলিত ধারণা যে আজ আর নির্ভরযোগ্য নয়, তা ফুটে ওঠে।

শ্রমসাধ্য গবেষণা, প্রাচীন সূত্রের অনুসন্ধান এবং সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সমন্বয়ে গঠিত এই গ্রন্থ সমাজ গবেষণার ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'নির্বাচিত বাংলা গ্রন্থের তালিকা' (১৯৮১–৮২)-তেও গ্রন্থটি স্থান পেয়েছে। এছাড়া আজকাল পত্রিকার (২৩ জানুয়ারি ২০০০) ‘সেরা বাছাই’ তালিকায় মহাশ্বেতা দেবীর নির্বাচিত বইয়ের মধ্যেও এই গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে—যা এর গুরুত্বকে আরও দৃঢ় করে।

উপনামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক বিন্যাস, এবং বাঙালি পরিচয়ের সংগঠনে উপাধির ভূমিকা বুঝতে ইচ্ছুক যে কোনো পাঠকের জন্য এই গ্রন্থ অপরিহার্য। অভিধানের মতোই রক্ষণযোগ্য, তথ্যসমৃদ্ধ এবং গবেষণামূলক এই বইটি বাংলা সমাজতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এক মূল্যবান সংযোজন।