নির্জন, সীমাহীন এক পথ। দিগন্তে কোনো রেখা নেই, দিকনির্দেশ নেই—শুধু এক সুউচ্চ পুরুষ এগিয়ে চলেছেন স্থির পদক্ষেপে। তাঁর দীর্ঘ, গম্ভীর দাড়ির ছায়া যেন আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। হাতে তিনি দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছেন ত্রিশূল, আর তার সম্মুখেই টলমল করছে সমগ্র বিশ্ব। এক অলৌকিক দৃশ্য—বিশ্ব যেন তাঁর হাতের মুঠোয় বন্দি, অপেক্ষায় আছে তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য।

তাঁর আরেক হাতে একটি ক্ষুদ্র ডমরু। সে ডমরুর মৃদু নিনাদ ধীরে ধীরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে, যেন এক নতুন প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ছে মহাবিশ্বে। ধ্বনির প্রতিটি তরঙ্গ দোলায়িত করছে সময়ের বুকে, ঘুমন্ত সত্তাগুলোকে জাগিয়ে তুলছে। সৃষ্টির অনন্ত সুর বাজিয়ে চলেছে সেই ক্ষুদ্র বাদ্যযন্ত্র।

কিন্তু সময়ের নিয়ম বদলায়। ধ্বনির কম্পন বদলে যায়, তার ছন্দ হয়ে ওঠে অস্থির, প্রবল। আকস্মিকভাবে সেই পুরুষের দৃষ্টি কঠোর হয়ে ওঠে, তাঁর ত্রিশূলের প্রান্ত শিহরিত হয় এক মহাশক্তির প্রত্যাশায়। সৃষ্টির আশীর্বাদ নিয়ে যাঁর আবির্ভাব, তিনিই আবার হয়ে ওঠেন সংহারকর্তা। বিশ্বযাত্রার এক চিরন্তন চক্র শুরু হয় তাঁর হাত ধরে—সৃষ্টি, পালন এবং অবশেষে ধ্বংস।

তারপর… এক গভীর অন্ধকার নেমে আসে!

সমস্ত অস্তিত্ব হারিয়ে যায় শূন্যতায়। সময়ের প্রবাহ স্তব্ধ হয়ে পড়ে, যেন মহাশূন্য গিলে ফেলেছে সকল কিছু। কিন্তু এ নিঃশেষ নয়—কারণ ধ্বংসই নতুন সৃষ্টির ভিত্তি। আর তাই, সেই অন্ধকারের মধ্য থেকেই জেগে ওঠে এক বিস্ফোরণ! এক নতুন আলোর উদ্ভাস!

আবার শুরু হয় সৃষ্টি ও সংহারের চিরন্তন চক্র—যেখানে ধ্বংস কখনোই চূড়ান্ত পরিণতি নয়, বরং নতুন কিছু জন্ম নেওয়ার পূর্বক্ষণ।

এই গ্রন্থ সেই চক্রের রহস্য উন্মোচনের এক বিনীত প্রয়াস। সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার ধুলোঝড়া পথে ফিরে গিয়ে, লিঙ্গোপাসনার গভীর সাধনার মধ্যে দিয়ে, আগম ও পুরাণের গূঢ় দর্শনের আলোকে এবং লোকজ বিশ্বাসের প্রবহমান ধারায় আমরা খুঁজে দেখি সেই চিরন্তন সত্য—সৃষ্টি ও সংহারের এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র।

এ এক নিরবিচার অনুসন্ধান—সময়ের অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই মহাজাগতিক নিয়মের, যার প্রতিধ্বনি আজও প্রতিফলিত হয় আদি ও অনন্তের মিলনস্থলে।

"নমঃ শিবায়" —এক প্রার্থনা, এক অনুসন্ধান, এক অনন্ত সত্যের সন্ধান।