ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির সূচনা নিয়ে ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে আজও কিছু মতানৈক্য রয়ে গেছে। মূলত দুটি সালকে ঘিরেই এই বিতর্ক – ১৯২০ এবং ১৯২৫।

১৯২০: তাশখন্দে প্রবাসী সূচনা

১৯২০ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার তাশখন্দ শহরে মনবেন্দ্রনাথ রায় (এম এন রায়) এর নেতৃত্বে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের উদ্যোগে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম বীজ রোপিত হয়। এই দলটি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল (কমিন্টার্ন)-এর অংশ ছিল এবং আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল। যদিও এটি ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, অনেকেই একে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা হিসেবে দেখেন।

১৯২৫: কানপুরে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা

তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও দলীয় রেকর্ড অনুসারে, ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর, উত্তরপ্রদেশের কানপুরে একটি সম্মেলনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (CPI)-এর আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয়। এই সম্মেলনে এস এ ডাঙ্গে, মুজাফ্‌ফর আহমেদ, শওকত উসমানি, গোপাল বসু, ও অন্যান্য বামপন্থী নেতারা অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ সরকার এই পার্টিকে অবিলম্বে ‘বিদ্রোহী’ আখ্যা দেয় এবং পার্টির নেতাদের উপর ‘মুজাফ্‌ফরপুর ষড়যন্ত্র মামলা’ ও অন্যান্য মামলার মাধ্যমে দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

পার্টির লক্ষ্য ও প্রাথমিক কর্মসূচি

কমিউনিস্ট পার্টি ভারতীয় সমাজের শোষিত শ্রেণি — বিশেষত শ্রমিক, কৃষক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে শুরু করে। পার্টির মূল লক্ষ্য ছিল:

• সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
• জমিদারি ব্যবস্থার অবসান
• শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও কর্মপরিবেশ
• সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা

সমাজে প্রভাব ও ভূমিকা

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে তারা শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়, বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনে। বাম আন্দোলনের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও তেলেঙ্গানা অঞ্চলে তারা প্রভাব বিস্তার করে।

তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬–৪৭): পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। CPI এখানে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দেয়।

তেলেঙ্গানা আন্দোলন (১৯৪৬–৫১): হায়দরাবাদে জমিদার ও নিজামের দমননীতির বিরুদ্ধে গ্রামীণ বিদ্রোহ, যেখানে পার্টির পার্শ্ববর্তী গেরিলা যুদ্ধ কৌশলও দেখা যায়।

এই পার্টির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনকে সংঘটিত করা, এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পথে ভারতকে পরিচালিত করা। সেসময়ে ব্রিটিশ সরকার এই পার্টিকে বিপজ্জনক ও রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বিবেচনা করে এবং বহু নেতাকে কারাবন্দি করে (যেমন মুজাফ্‌ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, শওকত উসমানি প্রমুখ)।

স্বাধীনতার পর: সংসদীয় রাজনীতিতে CPI অংশগ্রহণ করে এবং কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গে একাধিকবার সরকার গঠন করে। তবে ১৯৬৪ সালে মতাদর্শগত বিভাজনের ফলে পার্টি বিভক্ত হয় — জন্ম হয় CPI(M) এর। ১৯৬০-এর দশকে চীন বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শগত সংঘাত ভারতীয় কমিউনিস্টদের মধ্যেও প্রভাব ফেলে। ফলে ১৯৬৪ সালে CPI ও CPI(M)-এর মধ্যে বিভাজন ঘটে। পরে আরও চরমপন্থী বামপন্থী দল তৈরি হয়, যেমন CPI(ML), যারা নকশাল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের শ্রমিক আন্দোলন, তেভাগা ও নকশালবাড়ি আন্দোলন সহ একাধিক ঐতিহাসিক কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক বিভাজন, আদর্শগত মতভেদ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে পার্টির একাধিক ভাগ হয়, যেমন CPI(M), CPI(ML) ইত্যাদি। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে কমিউনিস্ট পার্টির শুরু ছিল শ্রমিক শ্রেণির অধিকার ও সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠনের এক বলিষ্ঠ প্রত্যয়।